টিউমার থেকেই নাকি ক্যান্সারের সুত্রপাত হয়? এটা কি আসলেই সত্যি? চলুন তাহলে এর সত্যতা যাচাই করে আসি।
আমার কলেজের এক বন্ধু ছিল নাম ফাহিম। ও সেই অল্প বয়স থেকেই প্রচুর ধূমপান করত। ফাহিম আমাদের বলত ওর স্কুলে থাকতে কিডনিতে টিউমার ধরা পড়ে। যার চিকিৎসা সেভাবে করা হয়নি। আজকাল নাকি ওর শরীরে পেছন দিকে খুব ব্যাথা হয়। আমরা প্রায়ই ওকে বলতাম ডাক্তারকে দেখাতে আর ধূমপান ছেড়ে দিতে। কিন্তু, ফাহিম এসবের কিছুই কানে নিত না। ঠিক এইচ এস সি পরীক্ষার কিছুদিন আগে আমরা আচমকা জানতে পারি ফাহিম আর আমাদের মাঝে নেই। কারনস্বরূপ জানলাম ফাহিমের কিডনির টিউমার এতোদিনে ক্যান্সারে রুপান্তরিত হয়েছিল। আর ওর অবহেলার কারনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। সেদিন আমি আমার খুব ভালো বন্ধুটিকে ওর অবহেলারর জন্য এভাবে হারিয়ে ফেলছিলাম।
আপনারাও যদি চান সুস্থ থেকে টিউমারকে আগে থেকে মোকাবিলা করতে তাহলে এখনি জেনে নিন টিউমার চেনার উপায় গুলোকে। বর্তমান বিশ্বে বর্ধমান দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত, অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের কারণে অনেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সাধারণ একটি রোগ হলো টিউমার। অনেকেই জানেন না টিউমার কেন হয়। অনেকসময় আমাদের গাফিলতির কারণে টিউমার ক্যান্সারের রূপ নেয়। তাই সচেতনতা বাড়াতে জেনে নিন টিউমার কি, টিউমার চেনার উপায়, এটি কেন হয় এবং এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে।
টিউমার কি?
মানবদেহে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অস্বাভাবিক কোষ বা টিস্যুখন্ডকে টিউমার বলে।
কোষ বিভাজন জীবের বৃদ্ধি ও বংশবিস্তারের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রক্রিয়া। প্রকৃতকোষী জীবের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য বিভাজন প্রক্রিয়ার নাম মাইটোসিস। যা কোষের কেন্দ্রস্থিত নিউক্লিয়াসের ডিএনএ দ্বারা পরিচালিত হয়। কোনো কারণে এই ডিএনএ এর গঠন কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে এবং সেটা পুনরায় ঠিক করা বা মেরে ফেলা সম্ভব না হলে তখন সম্পূর্ণ কোষটি ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে। এই ত্রুটিযুক্ত কোষ মাইটোসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ার নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ভুল ডিএনএ গঠন কাঠামো বিশিষ্ট অনেকগুলো অস্বাভাবিক কোষ মিলে জন্ম দেয় টিউমারের। এভাবেই মানবদেহে টিউমার গঠিত হয়।ডায়াবেটিস রোগীর নিষিদ্ধ খাবার সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
টিউমার কেন হয়:
মানবদেহে বিভিন্ন কারণে এবং যেকোনো অঙ্গে টিউমার হতে পারে। টিউমার হওয়ার জন্য দায়ী এমন কিছু সাধারণ কারণ হলোঃ
* বংশগত কারণ
* জেনেটিক সমস্যা
* হরমোনাল সমস্যা
* কোনো রকম আঘাত লাগা
* কেমিক্যাল
* অনিয়ন্ত্রিতভাবে জীবন যাপন
* ঘন ঘন সন্তান প্রসব
* অ্যালকোহল, ধুমপান
* বিষাক্ত রাসায়নিক ইত্যাদি
টিউমারের ধরণ ও প্রকারভেদ:
মানুষের শরীরে বিভিন্ন রকম টিউমার দেখা যায়। ধরণ অনুযায়ী টিউমারকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো –
১.হিস্টোমা বা কানেকটিভ টিস্যু টিউমার
২.সাইটোমা
৩.টেরাটোমা বা মিক্সড সেল টিউমার।
এর মধ্যে হিস্টোমা টিউমার দুই ধরনের। বিনাইন টিউমার ও ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। মূলত মানবদেহে এই দুই ধরণের টিউমারই বেশি দেখা যায়। চলুন জেনে নেই এই দুই ধরণের টিউমার সম্পর্কে।
১. বিনাইন টিউমারঃ বিনাইন টিউমার হলো কিছু অস্বাভাবিক কোষের সমষ্টি যা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে না বা তার পাশের কোষকে আক্রমণ করতে পারে না। এ ধরণের কোষগুচ্ছ একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে। তাই এটি তেমন ক্ষতিকারক নয়। তবে মস্তিস্কের বিনাইন টিউমার ক্ষতিকর এবং এতে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।
২. ম্যালিগন্যান্ট টিউমারঃ যে ধরণের টিউমারে আক্রান্ত কোষগুচ্ছ একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ না থেকে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ার বারবার নিজের প্রতিলিপি গঠন করে এবং রক্ত ও লসিকা প্রবাহের মাধ্যমে সারা শরীরে মিশে যায় তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বলে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমার অনেক দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে যায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল করে দেয়। এদেরকে অন্যভাবে ক্যানসারাস বা ক্যান্সার বলে। কারণ এ ধরণের টিউমার থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক।
আরো পড়ুনঃ
ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়?
টিউমার চেনার উপায়:
মানবদেহের প্রায় প্রত্যেক অঙ্গেই টিউমার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিনাইন টিউমার দেহের ভেতর বা বাইরে উভয় স্থানে দেখা যেতে পারে। দেহের অভ্যান্তরীণ কিছু বিনাইন টিউমার হলো ব্রেন টিউমার, স্তন টিউমার, পাকস্থলী টিউমার, কিডনি টিউমার ইত্যাদি। এগুলো ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের মত বিভিন্ন শারীরিক পরিক্ষার মাধ্যমে সনাক্ত করা হয়। মানবদেহের বাইরের বিনাইন টিউমার চেনার উপায়ঃ
*এ ধরণের টিউমার দেখতে সাধারণত ফোঁড়ার মত হয়।
*এটি এক স্থানে স্থির থাকে, সারা শরীরে ছড়িয়ে যায় না।
* একটি মাত্র আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে।
* ভেতরের অংশ শক্ত থাকে।
* আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে
* ওষুধ বা অপারেশনের মাধ্যমে এ ধরণের টিউমার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
অন্যদিকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার নিশ্চিতকরণের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এর জন্য ডাক্তার সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান, ম্যামোগ্রাম বা এক্সরে করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। এ ধরণের টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন লক্ষণ প্রকাশ করে না। প্রথম দিকে ব্যাথামুক্ত টিউমার দেখা দেয়। টিউমারের আকৃতি অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কিছু এক পর্যায়ে ব্যাথ্যাযুক্ত হয় এবং সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের সাধারণ কিছু লক্ষণ হলোঃ
*ক্লান্তি
*ওজন হ্রাস এবং
* ব্যথা।
আসুন তাহলে জেনে নেই নিউমোনিয়া কি ধরনের রোগ, নিউমোনিয়ার লক্ষণ, কেন হয়, প্রতিকার এবং বিস্তারিত।
টিউমার কোথায় হয়ঃ
বিনাইন এবং ম্যালিগন্যান্ট টিউমার মানবদেহের বাহ্যিক ও অভ্যান্তরীণ উভয় পর্যায়ে দেখা যেতে পারে। বাহ্যিক টিউমার শনাক্তকরণ খুব সহজ হয়। শরীরের যেকোনো স্থানই টিউমার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
মানবদেহের যেসব স্থান বেশি টিউমার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে সেগুলো হলো হাত, পা, ঠোট, গলা, পিঠ, পাকস্থলী, স্তন, কিডনি, জরায়ু ও মস্তিস্ক। মহিলারা বেশি স্তন ও জরায়ু টিউমার সমস্যায় ভুগেন।
- সাধারণত মাথার খুলি, মুখ-মণ্ডল ও নাসিকা গহ্বর প্রভৃতি স্থানে হাড়ের অস্থি টিউমারকে অস্টিওমা,
- হাড়ের কার্টিলেজ এর টিউমারকে কনড্রমা,
- পিঠ ও কাঁধের ফ্যাটি টিস্যু টিউমারকে লিপোমা,
- চর্মের উপরের টিউমারকে এপিথেলিওমা,
- জরায়ু ও পাকস্থলীর টিউমারকে মাইওমা,
- নাক, জরায়ু প্রভৃতি শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির টিউমারকে প্যাপিলোমা,
- মস্তিষ্ক কোষের টিউমারকে গ্লাইওমা,
- মস্তিষ্ক, লিভার প্রভৃতি স্থানের লসিকা নালীর টিউমারকে লিমফ্যানজিওমা বলা হয়।
যাদের টিউমার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি:
সকল ধরণের টিউমার ক্যান্সার না ছাড়ালেও কিছু টিউমার এর জন্য দায়ী। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর দেড় লাখের বেশি মানুষ আমাদের দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত হন। তাই টিউমারের প্রথমিক পর্যায় থেকেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। টিউমারের ঝুঁকিতে রয়েছেন-
*বয়স্ক লোক
* বংশে কারো টিউমারের ইতিহাস থাকলে
* স্থুলকায় ব্যাক্তি
* ধুমপান,অ্যালকোহল বা তামাক সেবনকারী ব্যাক্তি
* অতিরিক্ত সূর্যরশ্নি ও রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা ব্যাক্তি
চিকিৎসা:
বর্তমানে টিউমারের চিকিৎসা পদ্ধতি দিন দিন আধুনিক ও উন্নত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে টিউমার শনাক্ত করা গেলে খুব সহজেই এর থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়।
বিনাইন টিউমার সাধারণত ওষুধ বা সর্বোচ্চ অপারেশনের মাধ্যমে সেরে যায়। এছাড়া হোমিওপ্যাথিক ওষুধও টিউমার উপশম করতে অনেক কার্যকরী।
ম্যালিগন্যান্ট টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা গেলে অল্প সময়ে এর চিকিৎসা করে সুস্থতা লাভ করা যায়। ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বেশি ছড়িয়ে গেলে তা ভয়াবহ ক্যান্সারের আকার ধারণ করে।
এছাড়াও অনেক সময় টিউমারের ধরণ অনুযায়ী কোমোথেরাপি, রেডিয়েশনথেরাপি, হরমোনথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, স্টোম সেল ট্রান্সপ্লেন্ট ইত্যাদি উন্নতমানের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
টিউমার রোধক খাবার:
সুস্থ জীবন যাপনের জন্য পরিমিত পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। আমাদের আশেপাশেই রয়েছে বিটা ক্যারোটিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানযুক্ত খাবার যা টিউমারের ঝুঁকি এড়াতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়। এগুলো হলোঃ
* হলুদ
* গ্রীন টি
* বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবার
* মিষ্টি আলু
* সবুজ শাক সবজি
* ক্যাবেজ জাতীয় সবজি যেমন- বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকোলি, ওলকপি ও শালগম
* রঙ্গিন ফল ও সবজি যেমন-পেঁপে, কমলা, লেবু, জাম্বুরা, মিষ্টিকুমড়া, গাজর ও স্কোয়াশ
* দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
* ফ্যাটি ফিশ
* মাশরুম
প্রতিরোধঃ
অনেকক্ষেত্রে টিউমার বংশগত বা জিনগত কারণে হয়ে থাকায় এটি একদমই প্রতিরোধ করা যাবে না তা কিন্তু নয়। সুস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করে আপনি অনেকাংশেই থাকতে পারেন টিউমারের ঝুঁকি মুক্ত। এজন্য যে বিষয় গুলো মাথায় রাখতে হবে-
* নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
* বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
* পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
* অতিরিক্ত ফ্যাটযুক্ত খাবার ও ফাস্ট ফুড পরিহার করতে হবে। পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খেতে হবে।
* ধুমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকতে হবে।
শরীরে কোনো রোগই বাসা বাধঁতে দেওয়া উচিত নয়। তাই টিউমারের উপস্থিতি টের পাওয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এছাড়াও সবসময় স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন ও ব্যাক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ
https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/21881-tumor
https://www.medicalnewstoday.com/articles/249141#summary
https://cancer.ca/en/cancer-information/what-is-cancer/types-of-tumours