ডায়বেটিস কমাতে সজনে পাতার জাদুকরী ভূমিকা

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অনেকেই খুঁজে ভেষজ ও ঘরোয়া সমাধান। তবে বেশ সহজলভ্য হওয়ার পরও অনেকেই জানে না ডায়াবেটিস রোগীর জন্য কাঁচা সজনে পাতার উপকারিতা।

সেদিন গ্রামে গিয়ে করিম চাচার সাথে দেখা হলো। শরীরের অবস্থা জিজ্ঞেস করতেই চাচা বললো ডায়াবেটিসের মাত্রা আজকাল একটু বেশিই থাকে ওনার। ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় প্রতিদিনের ওষুধ কিনতেও হিমশিম খেতে হয়। চাচাকে বললাম নিয়মিত সজনে পাতা সেবনে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে অনেকাংশে।

ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে সজনে পাতার ভূমিকা

আমাদের দেশের খুবই পরিচিত ও সহজলভ্য সবজি সজনে। সজনের বৈজ্ঞানিক নাম Moringa Oleofera। গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের সহজলভ্য উদ্ভিদ এটি। নানাবিধ ঔষুধি গুণের কারণে সজনে গাছকে মিরাকেল ট্রি বলা হয়। আদি কাল থেকে আমাদের রন্ধন ও চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় সজনে গাছের পাতা, ফুল, ফল, ছাল ও শেকড় ব্যাবহার হয়ে আসছে। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য উৎকৃষ্ট ভেষজ এই সজনে পাতা। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ওষুধের পাশাপাশি পরিমিত মাত্রায় সজনে গ্রহণ করলে রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস পায় কারণ সজনে পাতায় রয়েছে কয়েকটি ডায়াবেটিস রোধী উপাদান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০-৭০ বছর বয়সীদের মধ্যে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

আরো পড়ুনঃ

হার্টের রোগীর খাবার তালিকা 

ডেঙ্গু রোগীর খাবার তালিকা

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়?

সজনে পাতার পুষ্টিগুণ
তাই ঘরোয়া উপাদানে আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে আসুন জেনে নেই সজনে পাতার পুষ্টিগুণ ও সজনে পাতার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের উপায়ঃ

সজনে পাতার পুষ্টিগুণঃ

সজনে পাতাকে নিউট্রিশন্স সুপার ফুড বলা হয়। শরীরের জন্য কার্যকরী সকল ধরণের পুষ্টি উপাদান এতে বিদ্যমান। ২৫ টি অ্যামিনো এসিডের মধ্যে প্রায় ১৫টি অ্যামিনো এসিড সজনে পাতায় পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম সজনে পাতায় পাওয়া যায় –

  • শর্করা – ৮.২৮ গ্রাম
  • প্রোটিন – ৯.৪০ গ্রাম
  • স্নেহ – ১.৪০ গ্রাম
  • ফাইবার – ২.০ গ্রাম
  • ক্যালসিয়াম – ১৮৫ মিলিগ্রাম
  • লৌহ – ৪.০ মিলিগ্রাম
  • ম্যাগনেসিয়াম – ১৪৭ মিলিগ্রাম
  • সোডিয়াম – ৯ মিলিগ্রাম
  • ম্যাঙ্গানিজ – ০.৩৬ মিগ্রা
  • ফসফরাস – ১১২ মিগ্রা
  • পটাসিয়াম – ৩৩৭ মিগ্রা
  • সোডিয়াম – ৯ মিগ্রা
  • জিংক – ০.৬ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন এ – ৩৭৮ মাইক্রোগ্রাম
  • থায়ামিন (বি১) – ০.২৫৭ মিগ্রা
  • রিবোফ্লাভিন (বি২) – ০.৬৬০ মিগ্রা
  • নায়াসিন (বি৩) – ২.২২০ মিগ্রা
  • প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) – ০.১২৫ মিগ্রা
  • ভিটামিন বি৬ – ১.২০০ মিগ্রা
  • ফোলেট (বি৯) – ৪০ μg
  • ভিটামিন সি – ৫১.৭ মিলিগ্রাম
  • শক্তি – ৬৪ কিলোক্যালরি

সজনে পাতা যেভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়

সজনে পাতা যেভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়ঃ

ডায়বেটিস রোগীর জন্য কাচাঁ সজনে পাতা খুবই উপকারী। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে সজনে পাতা গ্রহণে কমিয়ে আনতে পারেন আপনার ঔষধ খরচ। এতে বিদ্যমান অ্যান্টিহাইপার গ্লাইসোমিক বৈশিষ্ট্য রক্তে শর্করার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। সজনে পাতায় থাকে ৪৬ রকমের অ্যান্টঅক্সিডেন্ট, আইসোথিয়োসাইনেট ও ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড যা রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে। আরো থাকে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড যা শরীরের ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়ায়। সজনেতে থাকা প্রোটিনও ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়। তাই প্রি ডায়াবেটিক এবং টাইপ টু ডায়াবেটিক রোগীরা নিঃসন্দেহে সজনে পাতা খেতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন ৫০ গ্রাম সজনে পাতা গ্রহণে রক্তে শর্করার বৃদ্ধি ২১% কমে যায়। ৩০ জন মহিলার মধ্যে অন্য একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে তিন মাস ধরে প্রতিদিন ১.৫ চা চামচ সজনে পাতার গুঁড়ো গ্রহণ করলে গড়ে খালি পেটে রক্তে শর্করার মাত্রা ১৩.৫% কমে যায়।এজমা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত জেনে আসি আমাদের এই আর্টিকেল থেকে।

সজনে পাতার অন্যান্য উপকারিতা

সজনে পাতার অন্যান্য উপকারিতাঃ

প্রায় ৩০০ রোগের ওষুধ হিসেবে পরিচিত এই সজনে পাতা। রোগ নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যেকোনো বয়সের মানুষ সজনে পাতা খেতে পারে। আসুন জেনে নেই অন্য যেসব শারীরবৃত্তীক সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় সজনে পাতা থেকেঃ

*রক্তসল্পতাঃএতে লৌহ এবং জিংক প্রচুর পরিমাণে থাকায় রক্তসল্পতা দূর করতে সহজেই আপনার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।

*হজম শক্তিঃ সজনে পাতায় প্রচুর ভিটামিন বি কমপ্লেক্স [থায়ামিন (বি১) রিবোফ্লাভিন (বি২) নায়াসিন (বি৩) প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) ভিটামিন বি৬ ফোলেট (বি৯)]পাওয়া যায় যা খাদ্যকে তাড়াতাড়ি হজম করে শক্তিতে রূপান্তর করতে সাহায্য করে।

*শ্বাসকষ্টেঃ যাদের শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমার সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য সজনে পাতা ও ডাঁটার রস খুবই উপকারি।

*দৃষ্টিশক্তিঃ সজনের ফুল ও পাতা চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

*কোলেস্টেরলঃ এটি সহজেই শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

*ত্বকঃ সজনে পাতার গুড়া ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি, বলিরেখা দূর এবং দাগ দূর করে।

*উচ্চরক্তচাপঃ এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে হার্ট ভাল রাখে।

*রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ সজনে পাতার এন্টি অক্সিডেন্ট এবং এন্টি ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

এছাড়াও মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধি, বার্ধক্য রোধ, ওজন কমানো, গ্যাসের সমস্যা, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, শরীরের টক্সিসিটি, চিকেনপক্স, হাড়ের সমস্যা এবং ক্যান্সার রোধেও এটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

ডায়াবেটিস রোগীরা যেভাবে সজনে পাতা খাবেন

ডায়াবেটিস রোগীরা যেভাবে সজনে পাতা খাবেনঃ

বাড়ির পাশে একটি সজনে গাছ লাগিয়ে দিলেই সারাবছর এর পাতা, ফুল, ফল সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়। রোপন পদ্ধতি ও বেশ সহজ। ডালের মাধ্যমে বা অঙ্গজ জননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করানো সম্ভব হয়। কয়েকভাবেই সজনে পাতা খাওয়া যায়। যেমন –

* তাজা পাতাঃ শাকের মত ভেজে সজনে পাতা ভাতের সাথে খাওয়া যায়। সজনে পাতা দিয়ে চা ও শরীরের জন্য উপকারী। এছাড়া সিদ্ধ করে, ভর্তা করে, স্যুপ বা জুস বানিয়েও খাওয়া যায়।

* সজনে পাতা গুড়োঃ সজনে পাতা ভালো করে শুকিয়ে গুড়া করে অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। এই গুড়া মধু দিয়ে বা ফুটন্ত পানিতে দিয়ে চা বানিয়ে খাওয়া যায়।

ডায়াবেটিস রোগীরা যেভাবে সজনে পাতা খাবেন

পার্শপ্রতিক্রিয়াঃ 

গবেষণায় পরিমিত পরিমাণে দৈনিক এই পাতা গ্রহণে কোনো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি। তবে সজনে পাতা সংলগ্ন ডালে কিছু বিষাক্ত উপাদান থাকে। তাই পাতা সংগ্রহ করার পর ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে এবং গর্ভাবস্থায় সজনে পাতা গ্রহণ করার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এখন হয়ত অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে শুধুমাত্র সজনে পাতা খেয়েই কি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব?না, সম্ভব নয়। সজনে পাতার অনেক ওষুধি গুনাগুন থাকলেও এটি একা রোগ নিরাময় করার জন্য যথেষ্ট নয়। ডায়াবেটিস রোগীরা রক্তের শর্করার মাত্রা কমাতে শুধুমাত্র সজনে পাতার উপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। এর পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চালিয়ে যেতে হবে সঠিক খাদ্যাভাস ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা। তবেই এটি একটি উত্তম সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

তথ্যসূত্রঃ

https://nutricles.com/want-to-cure-your-diabetes-with-moringa-train-your-body-naturally/

https://www.webmd.com/vitamins-and-supplements/health-benefits-moringa

Check Also

শারীরিক-ব্যায়ামের-উপকারিতা-ও-অপকারিতা.

শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতা ও অপকারিতা

ব্যায়াম হলো শারীরিক কার্যকলাপ  যা ফিটনেস এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে বজায় রাখে।  আপনি যদি আপনার শরীর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *