আমার দুঃসম্পর্কের এক ছোট ভাই আছে নাম সজীব। বয়স বেশি না মাত্র ২২ বছর। কিছুদিন আগে ও হার্ট অ্যাটাক করে। সবার একটাই প্রশ্ন ছিল কেন এই অল্প বয়সে ওর হার্ট অ্যাটাক হলো। ওর তো কোনপ্রকার খারাপ আসক্তি ছিলনা। তারপর ডাক্তার এর কাছ থেকে জানা গেল, সজীব এর বাইরে খাওয়ার একটা বদভ্যাস ছিল। ফাস্টফুড সহ নানারকম অস্বাস্থ্যকর খাবার খেত অসময়ে। বন্ধুবান্ধব দের সংগে বাইরেই খাওয়া পড়ত বেশি। সে ঘরে তৈরি খাবার পছন্দ করত না। এভাবে অনেকদিন একনাগাড়ে বাইরে বেশি দিন খাবার কারনে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। পরবর্তীতে,এটি তার হার্ট অ্যাটাকে রুপ নিয়েছে। আর তাই ডাক্তারের কঠোর নির্দেশ অনুযায়ী, সজীবের এখন হার্টের রোগীর খাবার তালিকা মেনে চলতে হয়। সে মোটেই বাইরের খাবার খেতে পারবেনা নয়ত জীবন ঝুঁকি আছে।
উপরোক্ত লিখার মাধ্যমে আমরা এতটুকু বুঝতে পারছি যে শরীরে হার্টের ঝুকি এড়াতে হার্টের রোগীর খাবার তালিকা নিয়ন্ত্রন কতটা জরুরী। এমনটা ভাবার কোন কারন নেই যে এটি বয়স বাড়লে হয়, কেননা হার্টের সমস্যা যে কোন বয়সের মানুষের হতে পারে। একসময় মনে করা হতো, বয়স্কদের হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু, বর্তমানে যেকোন বয়সের হার্টের রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অনিয়ম করে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। কিন্তু, আমরা সবাই যদি স্বাস্থ্যকর খাবার তালিকা নিয়ন্ত্রন করতাম তাহলে হার্ট নিয়ে আর এতো সমস্যা থাকতো না।
নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য খাবার তালিকা দেয়া হলো যেগুলো হার্টের রোগীদের জন্য অনেক উপকারী।
শাকসবজি এবং ফলসমূহ:
বিটরুটঃ হার্টের রোগীরা বিট্রুট খাবে কারণ বিট্রুটে রয়েছে উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন C ও পটাশিয়াম। ভিটামিন C হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান। এমনকি এটিতে ক্যালসিয়ামের উপাদান রয়েছে এবং এটি রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে। বিট্রুটে আছে পটাশিয়াম এবং মিনারেল যা হার্টের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখে এবং রক্তচাপ কমায়।
বেগুনঃ হার্টের রোগীদের বেগুন খাওয়া উচিত কারণ এতে আছে ভিটামিন A, ভিটামিন C, ফোলেট, পটাশিয়াম এবং ফাইবার যা হার্টের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ফোলেট এমন একটি ভিটামিন যা হৃদপিন্ডের কাজে স্বাস্থ্যকর ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও বেগুনে রয়েছে পটাশিয়াম এবং মিনারেল। যা রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদপিন্ডের জন্য ভীষণ উপকারি।ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
ব্রকোলিঃ হার্টের রোগীরা ব্রকোলি খেতে পারে কারণ ব্রকোলি এমন একটি স্বাস্থ্যকর খাবার যা হার্টের স্বাস্থ্য আরো উন্নত করতে সাহায্য করে। ব্রকোলি ফাইবারের মাধ্যমে কোলেস্টেরলের স্তর কমাতে সাহায্য করে। এটি আরও স্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল (হাই-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন) বা HDL বাড়াতে সাহায্য করে এবং খারাপ কোলেস্টেরল (লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন) বা LDL কমাতে সাহায্য করে।
ব্রকোলিতে আরো আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি ও ভিটামিন এ যেগুলো হার্টের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। ব্রকোলিতে পটাসিয়াম আছে যা ব্লাড প্রেশার ও কোলেস্টেরল স্তর নিয়ন্ত্রণে রাখতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। ব্রকোলি ফোলেটের একটি সুস্বাস্থ্যকর উৎস হতে পারে। এটা হার্টের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পালং শাকঃ পালং শাক ফাইবার এবং অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি গুণক পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার। এটি কোলেস্টেরলের স্তর নিয়ন্ত্রণে রাখে যার কারনে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। পালং শাক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ও সিলেনিয়াম বহন করে। এগুলো ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে এবং হার্টের সঠিক কার্যক্রম চালু রাখতে সাহায্য করে।
পালং শাকে নাইট্রেট আছে, যা মূলত নাইট্রিক অক্সাইড (NO) তৈরির জন্য একটি প্রাকৃতিক উৎস হতে পারে। NO মৌলিকভাবে ব্লাড ভেসেলগুলি দিয়ে মাংশপেশী প্রাকৃতিকভাবে সচল রাখে এবং ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পালং শাক ফোলেটের একটি সুস্বাস্থ্যকর উৎস। হার্টের রোগীরা পালং শাক খেলে তাদের হার্টকে সচল রাখতে এটি অসাধারন ভূমিকা রাখে। আরও পড়ুনঃডায়াবেটিস কমানোর উপায় সম্পর্কে।
আপেলঃ আপেলে প্রচুর ফাইবার থাকে। এটি অতিরিক্ত কোলেস্টেরলের স্তর নিয়ন্ত্রণ করে তার সাথে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদান করে। যা হার্টের স্বাস্থ্য সুন্দর রাখে। আপেলে আছে পটাসিয়ামে যেটি ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে করে। এছাড়াও আছে ভিটামিন সি, বিভিন্ন প্রকারের মিনারেল, যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য গুণকারী হতে পারে।
আপেল ফোলেটের একটি সুস্বাস্থ্যকর উৎস। আপেলে আছে আরো উপকারী উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, থিয়ামিন, নিয়াসিন, ম্যাগনেসিয়াম, এবং কোলেন। তাই হার্ট এর রোগীরা প্রতিদিন খাবার তালিকায় আপেল রাখবেন।
কমলাঃ হার্টের রোগীরা অবশ্যই তাদের খাদ্য তালিকায় কমলা রাখতে পারেন। কারণ কমলা এতটাই স্বাস্থ্যকর ফল যা খাওয়ার সাথে সাথে হার্টের স্বাস্থ্যে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে। কমলায় অধিক পরিমাণে ভিটামিন সি সরবরাহ করে, যা একটি ক্যাটিয়ান্ট অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং হার্ট সার্কুলেশন ভালো রাখে, ব্লাড ভেসেল এবং কোলেস্টেরলের স্তর নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। কমলাতে আরো আছে ফাইবার, পটাসিয়াম, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
কলাঃ কলা হার্টের রোগীদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ফল। এতে রয়েছে ফাইবার, পটাসিয়াম, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিভিন্ন প্রকারের ভিটামিন ও মিনারেল, ফোলেট সহ নানা পুষ্টিগুন। এগুলো কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখে, ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে তাছাড়াও হার্ট ভালো রাখার নিশ্চয়তা প্রদান করে।হাই প্রেসার বা উচ্চ রক্ত চাপ এর লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
নাশপাতিঃ নাশপাতি হার্টের রোগীদের জন্য আরো একটি উপকারী ফল। এটি শরীরে বিপুল পরিমানে ভিটামিন ডি, সি, কে, ফাইবার পটাসিয়াম, মিনারেল সরবরাহ করতে সাহায্য করে, যা হার্টের জন্য অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাশপাতি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বহন করে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
পেয়ারাঃ হার্টের রোগীরা পেয়ারা খেতে পারেন কারণ পেয়ারায় আছে ভিটামিন সি এবং বি৬, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ফাইবার। ভিটামিন সি ক্যাটিয়ান্ট অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে। পেয়ারা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদান করে, যা হার্টের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল মোকাবিলা করতে পারে।
আঙ্গুরঃ আঙ্গুর ফলে অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদান করতে পারে, যা হার্টের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এটি মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আঙ্গুরে বিভিন্ন প্রকারের ভিটামিন ও মিনারেল আছে। আঙ্গুর পটাসিয়ামে ভরপুর। এমন আরো অনেক ভিটামিনযুক্ত ফল ও শাকসবজি আছে যেগুলো হার্ট এর জন্য খুব উপকারী। এর মধ্যে বেরি, পীচ, পিয়ার, পেঁপে, কিউই ইত্যাদি।
অন্যান্যঃ
ব্রাউন রাইস, ওটস, বার্লি ইত্যাদি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে।
বোনলেস চিকেন, টার্কি, টুনা, স্যামন মাছ প্রভৃতি এগুলি প্রোটিন এবং ওমেগা-3 ফ্যাটি পুষ্টিগুন বহন করে থাকে।
দুধ, দই, চীজ ইত্যাদি খাবার ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন D সরবরাহ করে, যা হার্ট ভালো রাখতে সহায়তা করে।
পর্যাপ্ত পরিমান পানি পান করা অত্যন্ত উপকারী হার্টের রোগীর জন্য। ঘরে বানানো ফলের জুস, ডাবের পানি, দুধ, টক দই, চিকেন অথবা সব্জির স্যুপ, গ্রিন টি, লেবুর শরবত, চিনি ছাড়া ঘরে বানানো চা ইত্যাদি প্রচুর পরিমানে স্বাস্থ্যকর পানীয় পান করা উচিত।
তবে অনেকের ক্ষেত্রে লিঙ্গ ও বয়সভেদে শরীরে বিভিন্ন জটিলতার কারনে প্রত্যেক রোগীর চিকিৎসা এবং খাদ্য তালিকা ভিন্ন হতে পারে। তাই অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই হার্টের রোগীর খাবার তালিকা নিশ্চিত করা উচিত। অন্যথায় রোগীর জন্য সেটা ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ।
তথ্যসূত্রঃ
Retrieved from The National Heart, Lung, and Blood Institute (NHLBI) :
https://nhlbi.nih.gov/health/heart-healthy-living/healthy-foods
Retrieved from healthline :
https://www.healthline.com/nutrition/heart-healthy-foods#TOC_TITLE_HDR_6