এজমা থেকে মুক্তির উপায়

নিউমোনিয়া কি ধরনের রোগ
এজমা থেকে মুক্তির উপায়

আমার ছোট বোন জেসমিন, ক্লাস ৮ এ থাকতে ওর প্রায়ই বুকে ব্যাথা আর শ্বাসকষ্ট হতো। তখন শীতকাল থাকায় আমরা ব্যাপারটা ওতোটা গুরুত্ব দেইনি। ভেবেছিলাম এটা স্বাভাবিক, হয়ত আবহাওয়া পরিবর্তনের কারনে ওর এমনটা হচ্ছে। কিন্তু, দিনদিন জেসমিনের শ্বাসকষ্ট আরো বাড়তে লাগল। অবস্থা বেগতিগ দেখে আমরা তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সাথে সাথে ওকে নিয়ে গেলাম ঢাকার মহাখালীতে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। ডাক্তার সব কিছু শুনে সাথে সাথে ওকে কিছু পরীক্ষা করতে দিল। এরপর পরীক্ষাতে উঠে আসল যে ওর এজমার সমস্যা রয়েছে। যেটা আমরা ভাবতেও পারিনি এতো অল্প বয়সে এজমার সমস্যা। আমাদের আশ্বস্ত করে ডাক্তার বললেন, এটা জেসমিন বংশগত কারনেই পেয়েছে কারন আমার দাদারও এজমার সমস্যা ছিল। তাছাড়া, জেসমিনের এখনো অনেক খারাপ পর্যায় চলে আসে নি। তবে এক্ষেত্রে একদমই অবহেলা করা যাবেনা এবং নিয়মমাফিক চিকিৎসার মধ্যে থাকলে এজমা নিয়ে ভয় পাবার কিছুই নেই।

এজমা থেকে মুক্তির উপায়

তবে আপনি কি জানেন, বাংলাদেশ সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে সমগ্র পৃথিবীতে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। এই বিশাল জনসংখ্যার দেশে এজমা সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। শীত আসা মাত্রই আমাদের দেশে এজমা রোগীদের মধ্যে  এক রকমের উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারন, ঠাণ্ডা বাড়লেই এজমা রোগীদের কষ্ট বহুগুনে বেড়ে যায়। কথা বলা তো দূরে থাক শ্বাস নেওয়াটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগন বলে থাকেন যে, বায়ু দূষণ ও বংশ গত কারনে এজমা রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। আবার একবার এই রোগ হলে এর থেকে পরিত্রান পাওয়া অত্যাধিক দুষ্কর।  আচ্ছা, আপনি নিজেও কি এজমায় ভুগছেন? চিন্তা করছেন কিভাবে এই যন্ত্রণা থেকে একটু মুক্তি লাভ করা যায়? আসুন তাহলে এজমা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত জেনে আসি আমাদের এই আর্টিকেল থেকে।  এজমা একটি শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘকালীন অসুখ। যার দরুন শ্বাসনালী ফুলে যেতে পারে আবার সংকুচিত হতে পারে। শ্বাসনালীর ছিদ্রপথ সংকুচিত হবার ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি করে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞদের মতে এজমা বংশানুক্রমিক এবং স্থায়ী একটি রোগ। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক কি কি লক্ষন দেখলে বুঝবেন যে আপনার এজমা হতে পারে।

এজমা রোগের মূল লক্ষণ
এজমা রোগের মূল লক্ষণ

এজমা রোগের মূল লক্ষণ হলো:

শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসনালী সংকুচন (Wheezing): এজমা রোগে শ্বাসকষ্ট ও সংকুচন হয় ফলে এই সময় শ্বাস নেওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

শ্বাস নেওয়ার সময় দুর্বলতা (Shortness of Breath): এজমা রোগীর মাঝে শ্বাস নেওয়ার সময় অনেক  দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভূত হয়।

কাশি এবং সর্দি (Coughing): এজমা রোগীর শুকনো কাশি এবং সর্দি অনুভব করতে পারেন। অনেকের রাতে ঘুমাবার সময় কাশির মাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যায়।

বুকে ব্যাথাঃ অনেকেই মনে করেন যে, ঠাণ্ডা লাগলে কিংবা গ্যাসের সমস্যা হলেই বুঝি বুকে ব্যাথা করে। কিন্তু তা নয়, এজমাতেও বুকে ব্যাথা করে। তাই এই লক্ষন থাকলে কোনভাবেই অবহেলা নয়। সাথে সাথেই ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া উত্তম।  

শ্বাস নেওয়ার সময় শব্দ (Noisy Breathing): শ্বাস নেওয়ার সময় অনেক সময় শব্দ হয় যা শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষভাবে যা বাচ্চাদের মধ্যে বেশি হতে পারে। তাই খেয়াল রাখা উচিত।

শরীরের ওজন বজায় রাখাঃ যাদের অতিরিক্ত ওজন রয়েছে তাদের জন্য অতি দ্রুত ওজন কমানো উচিত। কারন, ওজন না কমলে আপনার হার্ট, শরীরের জয়েন্ট এবং ফুসফুসের জন্য অত্যন্ত হানিকর।

রাতে শ্বাসে সমস্যা (Nighttime Symptoms): অনেক সময় এজমা রোগীর রাতে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে। যা কিনা বিশেষ করে ঘুমানোর সময় হয়ে থাকে আবার একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় কথা বলতে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বৃদ্ধি হয়।

এই লক্ষণগুলি মূলত এজমা রোগের লক্ষণ। বয়সভেদে ও অবস্থান অনুযায়ী এজমা রোগীর শ্বাসক্ষমতা আলাদা হতে পারে, তাই যদি এই লক্ষণগুলো বুঝতে পারেন তাহলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে দ্রুত পরামর্শ করুন ।

আপনি ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে জানতে চান তবে  এই লিঙ্কে ক্লিক করুন ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

এজমা থেকে মুক্তির উপায়
এজমা থেকে মুক্তির উপায়

এজমা থেকে মুক্তির উপায়

এজমা এমন একটি রোগ যা থেকে পুরোপুরি ভাবে মুক্তি পাওয়া যায় না। কারণ, এজমা একটি ক্রোনিক (দীর্ঘকালিক) রোগ যা আপনার জীবনের একটি অংশ হতে পারে। তবে, সঠিকভাবে জীবনযাপন অনুসরণ করলে আপনি এজমা রোগটিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন। অবশ্যই মনে রাখবেন, এজমা রোগ নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য ডাক্তারের সাথে সহযোগিতা করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়াঃ এটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ তাই, প্রথমেই একজন দক্ষ এজমা ডাক্তারের শরনাপন্ন হবেন এবং তার দেওয়া নির্দেশনা অনুসরন করবেন।

ঔষধের প্রেসক্রিপশন সঠিকভাবে অনুসরণ করা: আপনার ডাক্তার এর দেওয়া ঔষধের সঠিক প্রেস্ক্রিপশন অনুসরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রিগার ফ্যাক্টর সনাক্ত করা এবং এগুলি পরিহার করা: আপনার এজমা ট্রিগার ফ্যাক্টর সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ধূমপান, এলার্জি, ধূলোবালি ইত্যাদি। এগুলো অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।

শ্বাসকষ্ট নিয়ন্ত্রণে রেগুলার চেকআপ করানো: আপনার ডাক্তারের সাথে নিয়ম করে রেগুলার চেক আপ করান। যার মাধ্যমে আপনার শ্বাসকষ্ট সম্পর্কে বর্তমান অবস্থা এবং এটি নিয়ন্ত্রিত আছে কিনা সে সম্পর্কে সবসময় অবগত থাকতে পারেন।

ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর খাবার:  এজমা রোগীদের প্রাকৃতিকভাবে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা বাড়াতে ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন করলে তা শরীরের জন্য খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। তাই, যদি এটি কোনভাবে অভ্যাসে রপ্ত করে ফেলা যায়, তাহলে এজমা নিয়ন্ত্রনে থাকবে। তবে অবশ্যই ঠান্ডা কিংবা শীতের সময়  ভারি বা বেশি ব্যায়াম করা এড়িয়ে চলবেন। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলবেন।

সময়মত টিকা দিনঃ এজমায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সময়মত তাদের নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা ছাড়াও করোনার বুস্টার ডোজ দিয়ে ফেলবেন। তাহলে জীবানুর আক্রমন থেকে অচিরেই মুক্তি পাবেন।

প্রতিরোধকারী ওষুধ:  যদি কারো উচ্চমানের এজমা থাকে তবে ডাক্তার তাকে এজমা প্রতিরোধকারী ঔষধ নির্ধারণ করে দিতে পারেন। যা এজমা কন্ট্রোল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

ঔষধ আপনার নাগালে রাখুনঃ ঔষধ সবসময় হাতের নাগালে রাখবেন। আর ইনহেলার ব্যবহার করলে সবসময় নিজের সাথে রাখার চেষ্টা করুন।  কারন, আপনি যদি আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে অতি দ্রুত ঔষধ গ্রহন করতে পারবেন।

পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখুনঃ আপনার বাড়ি এবং তার চারপাশের পরিবেশ সর্বদা পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখুন। এমনকি কাঁথা, বালিশ, লেপ- তোষক, আসবাবপত্র ইত্যাদি। ঘরে কোন কার্পেট ব্যবহার করবেন না।

ঠান্ডা খাবার পরিত্যাগ করাঃ এজমা রোগীকে কোন ভাবেই ঠান্ডা খাবার, আইসক্রিম গ্রহন করা যাবে না। এসব খাবার থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।

আরো রয়েছে যেমন, পোষা প্রানী থাকলে প্রত্যহ তাকে গোসল ও পরিস্কার রাখতে হবে। যতটুকু সম্ভব মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকতে হবে।

কি ধরনের খাবার খেলে  এজমা দূর হতে পারে: এজমা রোগের সহায়ক খাবার সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম কানুন নেই, কিন্তু আপনি স্বাস্থ্যকর খাবার এবং আপনার প্রাকৃতিক শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিম্নলিখিত খাবার তালিকা অনুসরন করতে পারেন:

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: মাংস, মাছ, ডাল, ডেইরি প্রোডাক্ট, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার এজমা রোগের সহায়ক হতে পারে কারণ এগুলি শ্বাস ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে।

ফল এবং সবজি:  ফল এবং সবজি আপনার শ্বাস ক্ষমতা প্রাকৃতিকভাবে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

ওমেগা-3 ফ্যাটি এসিড: মাছ (যেমন, সালমন) এবং অন্যান্য ওমেগা-3 ফ্যাটি এসিড ধারণ করা খাবার খেলে তা এই রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: এজমা রোগী যদি বিভিন্ন সবজি, ফল, গাজর, মশুর ডাল, চা, গ্রিন টি, পালং শাক ইত্যাদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে যোগ দেয়, যার ফলে এজমা রোগের নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

কি ধরনের খাবার খেলে এজমা দূর হতে পারে
এজমা রোগীদের জন্য বিশেষ কিছু খাবার
এজমা রোগীদের জন্য বিশেষ কিছু খাবার

এজমা রোগীদের জন্য বিশেষ কিছু খাবারঃ

এজমা রোগীদের জন্য এমন কিছু বিশেষ খাবার আছে যা খেলে তাদের প্রাকৃতিকভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। যেমনঃ লেবু, পেয়াজ, মধু, রসুন, আদা, কফি, ল্যাভেন্ডার তেল ইত্যাদি। এই প্রতিটি খাবারে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন উপাদান আছে যা কিনা  এজমা রোগীর জন্য অসীম উপকারিতা বয়ে আনে। তবে এসব উপাদানগুলো হলো ঘরোয়া যেটা সাময়িকভাবে শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাই, চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী খাবার এর তালিকা অনুসরন করা অধিক উত্তম।

এজমার কারন সাধারনত কি?
এজমার কারন সাধারনত কি?

এজমার কারন সাধারনত কি?

এজমা (Asthma) একটি শ্বাসকষ্টজনিত রোগ যা মৌলিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা দেয়।এজমার কারণ নিম্নলিখিত কারনে হতে পারে: বাতাসে ধূলিকনা, বায়ুদূষণ, কারখানায় ব্যবহৃত কেমিক্যালস, যেমন গ্যাস, রাসায়নিক বস্তুর ব্যবহার, ইত্যাদি এজমার কারণ হতে পারে। বংশগত কারনে যেমন অনেকেরই রক্তের সম্পর্কের কারোর এজমা থাকলে এটি হয়ে থাকে। এজমা কোন ভাইরাসজনিত রোগ নয়।

হাই প্রেসার বা উচ্চ রক্ত চাপ এর লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে লিঙ্কে ক্লিক করুন।

বাংলাদেশে এজমার প্রভাব কি রকম?

বাংলাদেশে এজমার প্রভাব কি রকম?

বাংলাদেশে এজমা একটি ব্যাপক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং দেশের বেশির ভাগ বয়স্ক ও শিশু এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। যদিও এর কোন সঠিক বয়সসীমা নেই। তাই এটি যেকোন সময় যে কারোর হতে পারে। কেননা, বায়ু দূষনের কারণে শ্বাসকষ্ট বেড়ে এজমার ভয়াবহতা সৃষ্টি করে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরের প্রবল বায়ু দূষণ পরিস্থিতি, এজমা রোগের প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য অনেকাংশে দায়ী। 

যদিও, বাংলাদেশে এজমা রোগ ব্যাপকভাবে বেড়েই চলেছে। তবে এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা আগে থেকে উন্নত হয়েছে। আর তাই সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শের জন্য স্থানীয় ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজমা রোগের প্রভাব কমাতে এবং এজমা রোগীদের নিরাপত্তা বাড়াতে সকলের এই রোগ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।এজমা থেকে মুক্তি লাভ করতে হলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে সরকারসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

তথ্যসূত্রঃ

https://www.healthline.com/health/asthma

https://my.clevelandclinic.org/health/diseases/6424-asthma

Check Also

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়?

আপনি কি জানেন? ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়? মানবদেহে ডায়াবেটিস ৪০ mg/dl এর নিচে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *