নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের কার্যকরী টিস্যু প্যারেনকাইমার প্রদাহজনিত রোগ যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা অন্যান্য পরজীবীর সংক্রামণে ঘটে। ফলে ফুসফুসের একটি বা উভয় বায়ু থলি তরল বা পুঁজ জাতীয় পিউলিয়েন্ট উপাদান দ্বারা পূর্ণ হয়ে স্ফীত হয়ে যায়। শ্বসনযন্ত্রের সিনসিটিয়াল ভাইরাস এবং ফুসফুসের স্টেপটোকক্কাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার জন্য যথাক্রমে ভাইরাল নিউমোনিয়া ও ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া ঘটে।
আমার বোনের ছেলে নাম রোহান বয়স মাত্র ৩ বছর। কিছুদিন আগেই ওরা বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে থেকে ঘুরে আসলো। ঢাকার বাইরে ততক্ষনে শীত শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে ফেরা মাত্রই ওর ঠান্ডার সমস্যা দেখা দিল। প্রথমে ব্যাপারটা কেউ গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে রোহানের কাশি, জ্বর ও সর্দি বেড়ে গেল। এমনকি, একপর্যায়ে শ্বাসকষ্টের মত সমস্যা দেখা দিল। ডাক্তারের কাছে গিয়ে শারীরিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা জানতে পারলাম ওর নিউমোনিয়া হয়েছে। ডাক্তার বললো, এই আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় বাচ্চাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার কারনেই ওর নিউমোনিয়া হয়েছে। তাই সবসময় যেকোনো ঋতু পরিবর্তনের সময় বাচ্চাদের খেয়াল করা খুবই অত্যাবশ্যক। জানলে অবাক হবেন, শুধু শিশুরাই নয়, নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হতে পারে যেকোনো বয়সের মানুষ। তাই দরকার সঠিক সচেতনতা।
আসুন তাহলে জেনে নেই নিউমোনিয়া কি ধরনের রোগ, নিউমোনিয়ার লক্ষণ, কেন হয়, প্রতিকার এবং বিস্তারিত।
নিউমোনিয়ার লক্ষণঃ
নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরভেদে এবং সংক্রামকের ধরণ অনুযায়ী ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
- জ্বর। (৭১-৭৫%)
- শুকনো কাশি। (৭৯-৯১%)
- ক্লান্তি। (৯০%)
- শ্বাসকষ্ট। (৬৭-৭৫%)
- শ্বাস নেওয়ার সময় বুকে ব্যাথা অনুভূত হওয়া। (৩৯-৪৯%)
- মাংসপেশিতে ব্যাথা।
- ক্ষুধা কমে যাওয়া।
শিশুদের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় উপসর্গ:
শিশুদের জন্য নিউমোনিয়া অভিসাপসরূপ। ২০১৮ সালের পরিসংখান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়।
- মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার জ্বর।
- শিশুর দূর্বল ভাব এবং খাদ্য গ্রহণে অনীহা।
- ঘনঘন শ্বাস গ্রহণ করা।
- ০-২ মাসে মিনিটে ৬০ বারের বেশি শ্বাস,
- ২-১২ মাসে মিনিটে ৫০ বারের বেশি শ্বাস,
- ১-৫ বছরে মিনিটে ৪০ বারের বেশি শ্বাস,
- শিশুর বুকের ভেতরে ঘড়ঘড় আওয়াজ হওয়া।
- পাঁজরের নিচের অংশ ভেতরের দিকে চেপে যাওয়া।
- রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার ঠোঁট বা নখ নীলচে হয়ে যাওয়া।
যাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি –
- ষাটোর্ধ বৃদ্ধ বা ২ বছরের কম শিশুরা।
- যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
- হৃদরোগ বা ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি।
- ধূমপায়ী।
- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস যাদের।
নিউমোনিয়া কি ছোঁয়াচে?
নিউমোনিয়া স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায় না অর্থাৎ ছোঁয়াচে নয়। তবে চিকিৎসকের মতে, আক্রান্ত ব্যাক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে নিউমোনিয়ার জীবাণু ছড়াতে পারে। একে ড্রপলেট ইনফেকশন বলে।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসাঃ
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা নিউমোনিয়ার ধরণ, পর্যায় ও সংক্রামক অনুজীবের ধরণের উপর নির্ভর করে। রোগীর অবস্থা বোঝার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এক্স-রে, রক্ত ও কফ পরীক্ষা করা হয়। ভাইরাল নিউমোনিয়া এক থেকে তিন সাপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়। অন্যান্য নিউমোনিয়ায় এন্টিবায়োটিক নিতে হয়। সঠিক সময়ে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা না হলে কখনো কখনো এই রোগ প্রাণঘাতী হয়ে উঠে।আপনি ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে জানতে চান তবে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ।
আসুন জেনে নেই নিউমোনিয়ার ঘরোয়া কিছু চিকিৎসা:
- সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
- কুসুম গরম পানিতে গোসল করতে হবে।
- হাঁচি ও কাশির সময় কাপড় বা রুমাল ব্যাবহার
- ঠাণ্ডা পানীয়, খাবার, অতিরিক্ত লবণ,স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট যুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।
- শিশুদের ডায়পার ঘনঘন পরিবর্তন করে দিতে হবে।
- শিশুদের সঠিক সময়ে নিউমোনিয়ার টিকা দিতে হবে।
নিউমোনিয়া রোগীর খাবার ঃ
এছাড়াও ঘরোয়া কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলো নিউমোনিয়ার কার্যকারিতা উপশম করে। এগুলো হলোঃ
লবন পানিঃ লবণ দিয়ে হালকা গরম পানিতে গার্গল করলে গলা ব্যাথ্যা ও কফের থেকে সাময়িক আরাম পাওয়া যায়।
পুদিনা, আদা চাঃ এগুলো ব্যাথ্যা উপশমকারী উপাদান। সেই সাথে কফ ও শ্লেষ্মা কমায়।
হলুদঃ হলুদে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি গুণ। যা শ্বাসযন্ত্রকে ভালো রাখে। নিউমোনিয়া চিকিৎসায় হলুদ গুড়া মেশানো চা খেতে বলা হয়।
দইঃ দইয়ে বিদ্যমান প্রোবায়োটিক উপাদান নিউমোনিয়া জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া প্যাথোজেন এর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে।
লেবুঃ লেবুতে বিদ্যমান ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
এর বাইরে প্রচুর পরিমাণে তরল ও সহজ পাচ্য খাবার দিতে হবে।আপনার সুস্থতার জন্য নিউমোনিয়া রোগীর খাবার গ্রহন সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।আসুন এজমা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত জেনে আসি আমাদের এই আর্টিকেল থেকে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধঃ
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এমন ব্যাক্তির নিউমোনিয়া হবার সম্ভাবনা বেশি। তাই ঝুঁকিযুক্ত ব্যাক্তিদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত, অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন পরিহার করে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে হবে। নিউমোনিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তি ধূমপান করবেন না। ঠান্ডা পরিবেশে বাচ্চাদের রাখা যাবে না। নির্দিষ্ট সময়ে নিউমোনিয়ার টিকা দিতে হবে। এছাড়া বাচ্চাদের প্রতি বছর ফ্লু ভ্যাক্সিন দেওয়া যেতে পারে। সেই সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পুষ্টিকর এবং শক্তি সমৃদ্ধ খাবার নিশ্চিত করতে হবে।
সতর্কতাঃ
নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে বাসায় বসে না থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ২ বছরের নিচে বাচ্চাদের জন্য শীতকালে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলেই নিউমোনিয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়। ধূমপান এবং মদ্যপান পরিহার করে , পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলে নিউমোনিয়া অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যায়। এরপরও কেউ নিউমোনিয়া আক্রান্ত হলে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই তার প্রতি অধিক যত্নশীল হতে হবে। তাই সবাইকেই সচেতন থাকা উচিত।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.lung.org/lung-health-diseases/lung-disease-lookup/pneumonia/symptoms-and-diagnosis
https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/pneumonia/symptoms-causes/syc-20354204