কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো হয়?

কেমন আছে আপনার কিডনি?মাঝে মাঝেই ঘুম থেকে উঠার পর আপনার মুখ বা চোখের নিচের অংশ বেশি ভারি ভারি হয়ে থাকে কি?সেই সাথে প্রায়ই খাওয়ায় অরুচী, বমি বমি ভাব ও দিন দিন চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে না তো?

এসব উপসর্গ গুলো যদি আপনার সঙ্গে মিলে যায় তবে আজই সতর্ক হন। কারণ কিডনি আক্রান্ত হ‌ওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত এই লক্ষণগুলোই প্রকাশ পেতে শুরু করে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে রাতে বার বার প্রস্রাবের বেগ হওয়া ,ঘন ঘন রক্ত শূণ্যতা,গায়ের রঙ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া,বিনা কারণে শরীর চুলকানোর মতো উপসর্গগুলোও দেখা দেয়।

 প্রথম অবস্থায় যদি রোগ ধরা যায় ও দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয় তবে সুস্থ হয়ে ওঠারও সম্ভাবনা থাকে।কিডনির সুস্থতা অর্থাৎ কিডনি ভালো আছে নাকি খারাপ আছে তা পয়েন্ট এর মাধ্যমে সাধারণত প্রকাশ করা হয় । কিন্তু একজন সুস্থ মানুষের জন্য কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো?

চলুন বিস্তারিত জেনে নেই আপনার কিডনির পয়েন্ট বলতে কি বোঝায়,কিডনির পয়েন্টের স্বাভাবিক মান ও এটা কিভাবে নির্ণয় করা হয় ,আপনার কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো এবং  কিডনি পয়েন্ট কমে গেলে কী কি সমস্যা হতে পারে। এছাড়া এই ব্লগ পোস্টটিতে  আমরা আরো আলোচনা করবো, কিডনির পয়েন্ট কেন হ্রাস/বৃদ্ধি হয় এবং কিডনির ভালো রাখার উপায়।

কিডনি রোগ কি ও কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো?

আমাদের কিডনির কাজ হল রক্ত থেকে বর্জ্য এবং পানি ফিল্টার করা। কিন্তু  যদি আমাদের কিডনি কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন এই রক্ত এবং বিষাক্ত ও বর্জ্য পদার্থ ফিল্টার করার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে  নিম্নলিখিতরোগ গুলি দেখা দিতে পারে:

  • Polycystic kidney disease(কিডনিতে সিস্ট)
  •  Lupus nephritis(কিডনির উপর শরীরের ইমিউন সিস্টেমের আক্রমণ)
  •  Interstitial nephritis(কিডনির টক্সিন ফিল্টার করার ক্ষমতা হ্রাস)
  •  Glomerulonephritis (গ্লোমেরুলার রোগ বা কিডনিতে অবস্থিত গ্লোমেরুলি বা  ক্ষুদ্র ফিল্টারগুলির প্রদাহ)
  • APOL1-mediated kidney disease(APOL1 জেনেটিক মিউটেশনের কারণে সংঘটিত একটি কিডনি ব্যাধি)
  •  Long-lasting viral illnesses(দীর্ঘস্থায়ী ভাইরাল রোগ), Pyelonephritis(কিডনি সংক্রমণ ও মূত্রনালীর পুনঃ পুনঃ সংক্রমণ)

‘কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো’ প্রশ্নটির উত্তর দিতে হলে প্রথমে জানতে হবে  1.ক্রিয়েটিনিন, 2.গ্লোমেরুলার পরিস্রাবণ হার বা GFR ও 3.প্রস্রাবের অ্যালবুমিন ক্ষরণ পরীক্ষা কি?এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন যে,আপনার কিডনি স্বাস্থ্য ভালো আছে নাকি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো

1.ক্রিয়েটিনিন কি?ক্রিয়েটিনিনের পরিমান নির্নয়:

আমাদের শরীরে একটি জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রিয়েটিনিন তৈরী হয়।এটি একটি বর্জ্য পণ্য যা স্বাভাবিক খাদ্যের প্রোটিন এবং পেশীর বিপাকের কারনে তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াটি ধ্রুবক হারে ঘটে এবং ক্রিয়েটিন রক্ত প্রবাহে মিশে যায়। রক্ত থেকে, কিডনি এটিকে ফিল্টার করে, প্রস্রাবের মাধ্যমে দেহের বাইরে নির্গত করে।

তবে  ভারী পেশীবিশিষ্ট মানুষ হালকা পেশীর লোকদের তুলনায় বেশি ক্রিয়েটিনিন তৈরি করে। মহিলাদের পেশীর ভর কম থাকে, ক্রিয়েটিনিন গঠন এবং নির্গমনের হার কম হয় তাই মহিলাদের সিরাম ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা কম ।

আরো পড়ুনঃ

হার্টের রোগীর খাবার তালিকা 

ডেঙ্গু রোগীর খাবার তালিকা

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়?

কেন রক্তের ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়?

রক্ত থেকে ক্রিয়েটিনিন অপসারণ করা কিডনির একটি কাজ। যখন আপনার কিডনির কার্যকারিতা কমে যায় তখন রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়।তাই কিডনির কার্যকারিতা মূল্যায়ন করতে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।

রক্তের ক্রিয়েটিনিনের সাধারণ মাত্রা কত?

সাধারণত আপনার রক্তের ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা বয়স, জাতি, লিঙ্গ এবং শরীরের আকারের উপর নির্ভর করে।

বয়স ভেদে ক্রিয়েটিনিনে সাধারণ মাত্রাগুলি হল:

 

বয়স

ক্রিয়েটিনিনে সাধারণ মাত্রা

16 বছর বা তার বেশি বয়সী (মহিলা)

0.৬-1.1 mg/dL

16 বছর বা তার বেশি বয়সী (পুরুষ)

0.৪-1.3 mg/dL

নবজাত থেকে ১৬ বছর

0.2 বা তার বেশি

কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো

জাতিভেদে রক্তে ক্রিয়েটিনিনের সাধারণ মাত্রা:

 

রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা

গড় রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা

 1.25 mg/dL

নন-হিস্পানিক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ

1.01 mg/dL

নন-হিস্পানিক কৃষ্ণাঙ্গ  মহিলা

1.16 mg/dL

নন-হিস্পানিক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ

 0.97 mg/dL

নন-হিস্পানিক শ্বেতাঙ্গ মহিলা

1.07 mg/dL

মেক্সিকান-আমেরিকান পুরুষ

0.86mg/dL

মেক্সিকান-আমেরিকান মহিলা

উচ্চ ক্রিয়েটিনিন স্তর কি?

উচ্চ ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বলতে সাধারণত 1.3 এর বেশি বোঝায়। আপনার উচ্চ ক্রিয়েটিনিন স্তর  কিডনির ক্ষতি বা ডিহাইড্রেশনের কারণে হতে পারে।

তবে এই মাত্রা বয়স, জাতি, লিঙ্গ এবং শরীরের আকারের উপর নির্ভর করে।

কিডনি সমস্যা ছাড়াও কিছু অবস্থার কারণে আপনার ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হতে পারে।

যেমন:

  • শুধুমাত্র একটি কিডনি বিশিষ্ট মানুষের স্বাভাবিক ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা প্রায় 1.8 বা 1.9 হতে পারে।
  • শিশুদের মধ্যে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা 2.0 বা তার বেশি হতে পারে।
  • শরীর কোনো কারণে ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। 

কিডনির পয়েন্ট কত হলে ভালো

নিম্ন ক্রিয়েটিনিন স্তর কি?

কম পেশী ভরের রোগীদের মধ্যে প্রায়ই নিম্ন ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দেখা যায়। তবে এটি সাধারণত কোনো গুরুতর চিকিৎসা সমস্যা হিসাবে ধরা হয় না।

2.গ্লোমেরুলার পরিস্রাবণ হার কি?

কিডনি আক্রান্তের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে জিএফআর কমে যায়।কিডনিগুলি কতটা ভাল ফিল্টার করছে তা জানতে ২৪ঘণ্টা প্রস্রাবের সাথে নির্গত বর্জ্যের পরিমাণ থেকে বা শিরায় দেওয়া বিশেষ মার্কার ব্যবহার করে GFR নির্ণয় করা হয়।

স্বাভাবিকভাবে সুস্থ পুরুষদের GFR এর মাত্রা প্রায় 100 থেকে 140 মিলি/মিনিট এবং মহিলাদের 85 থেকে 115 মিলি/মিনিট হয়ে থাকে। তবে এটি বয়সের সাথে সাথে সাধারণত হ্রাস পায়।

এজমা থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে বিস্তারিত জেনে আসি আমাদের এই আর্টিকেল থেকে।

আনুমানিক গ্লোমেরুলার হার (eGFR): 

 রক্তের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে আনুমানিক GFR বা eGFR পরিমাপ করা হয়।প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক রোগীর আক্রান্ত কিডনির পর্যায় সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন।

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা (CKD) সাধারণত একটি খুব ধীর প্রক্রিয়া যা প্রথমে খুব কম উপসর্গ প্রদর্শন করে। তাই, CKD কে 5টি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে CKD পর্যায় সনাক্ত করার জন্য,3 মাস বা তার বেশি সময়ে এই পরীক্ষাগুলি সাধারণত পুনরাবৃত্তি করা হয়। 

 eGFR এর ভিত্তিতে কিডনি রোগের পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয় ।পর্যায়গুলো জানার জন্য চলুন নিচের চার্টটি দেখি। 

CKD 

কিডনির আইকন 

 

eGFR 

uACR 

কিডনির পরিস্থিতি 

 

পর্যায় 1 

90 বা তার বেশি 

30 বা তার বেশিি 

কিডনি  সুস্থ 

পর্যায় 2 

kidney

60-89 

30 বা তার বেশি 

কিডনি ক্ষতির চিহ্ন 

পর্যায় 3a 

kidney

45-59 

30 বা তার বেশিি

কিডনির কার্যকারিতার হালকা থেকে মাঝারি ক্ষতি 

পর্যায় 3b 

kidney

eGFR 30-44) 

30 বা তার বেশিি 

কিডনির কার্যকারিতা মাঝারি থেকে গুরুতর ক্ষতি 

পর্যায় 4 

kidney

15-29 

30 বা তার বেশিি 

কিডনির কার্যকারিতার গুরুতর ক্ষতি 

পর্যায় 5 

kidney

15-এর কম 

 

কিডনি ব্যর্থতা 

অর্থাৎ তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে 60-এর কম eGFR এবং/অথবা 30-এর বেশি uACR কিডনি রোগ নির্দেশ করতে পারে। 

স্টেজ 5 এর রোগী অর্থাৎ যাদের জিএফআর 15 মিলি / মিনিট বা তার কম তাদের কিডনি  তার কাজ করার প্রায় সমস্ত ক্ষমতা হারিয়েছে। তাদের বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই নিয়মিত ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হবে।

3.প্রস্রাবের অ্যালবুমিন নির্ণয়

অ্যালবুমিন এক ধরণের প্রোটিন যা আমাদের রক্তে পাওয়া যায়।  কিডনি সুস্থ থাকলে এটিকে প্রস্রাবে যেতে বাধা দেয়। কিন্তু কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নিঃসরণ হতে পারে। সাধারণত, প্রস্রাবের অ্যালবুমিন ৩০ এর নিচে থাকা উচিত এবং তার চেয়ে উপরে হলে তা কিডনির সমস্যার ইঙ্গিত দেয় ।

কিডনির পয়েন্ট কমে যাবার লক্ষণ

  • মাথা ঘোরা,ক্লান্তি ও দুর্বলতা
  • শ্বাসকষ্ট
  • চুলকানি বা ফ্যাকাশে ত্বক ত্বক
  • হাত পায়ে বা মুখে ফোলাভাব
  • মুখে ধাতব স্বাদ
  • বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা ও হজমে সমস্যা 
  • ওজন হ্রাস 
  • প্রায়শই ঠান্ডা অনুভব করা
  • ঘন ঘন প্রস্রাব বা প্রস্রাবের রং পরিবর্তন
  • প্রস্রাবে ফেনা বা রক্ত  
  • পেট ফুলে যাওয়া
  • ঘুমের সমস্যা ও পেশী ক্র্যাম্প

কিডনির পয়েন্ট কমানোর উপায়

  • পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও তরল খাবার খান
  • তাজা ফল ও শাকসবজি এবং পুষ্টিকর খাদ্য খান
  • অতিরিক্ত  ও লবণ চিনিযুক্ত খাদ্য পরিহার করুন 
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলুন
  • উচ্চ পটাসিয়ামযুক্ত খাবার সীমিত পরিমানে খান
  • সঠিক ওজন বজায় রাখুন
  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ বন্ধ করুন
  • প্রোটিন গ্রহণ সীমিত করুন ও প্রাণীজ প্রোটিনের পরিবর্তে উদ্ভিদজ বেশি খান
  • আপনার কোলেস্টেরল, রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন
  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না
  • কিডনির পয়েন্ট ভালো আছে তা নিশ্চিত করতে বছরে ১ বার কিডনি পরীক্ষা করা উচিত ।

শেষকথা 

বস্তুত কিডনি মানবদেহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনি রোগ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী রোগ। এই কিডনি রোগটি খুব নীরবে শরীরের ক্ষতি করে তাই একে নীরব ঘাতক বলা হয়। 

 অনেক ক্ষেত্রে, একটি কিডনি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলেও অন্যটি কাজ করতে থাকে। ফলে কিডনির সমস্যার লক্ষণগুলো খুবই মৃদু হয় এবং রোগীর অজান্তেই ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।ফলশ্রুতিতে ২টি কিডনিই সম্পূর্ণ বিকল হওয়া,ফুসফুসে বা হৃদপিণ্ডের আস্তরণের চারপাশে তরল জমা, রক্তে পটাসিয়ামের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে গিয়ে হৃদযন্ত্রের কাজ করার ক্ষমতাকে ব্যাহত করা সহ মারাত্মক পরিণতি  এমনকি জীবন-হুমকিও হতে পারে। 

তাই কিডনি রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি এবং উপরোক্ত উপসর্গগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

তথ্যসূত্রঃ

https://www.medicinenet.com/creatinine_blood_test/article.htm

https://www.niddk.nih.gov/health-information/professionals/advanced-search/explain-kidney-test-results

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top