একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে, বিশ্বে প্রাপ্ত বয়ষ্ক প্রায় ৭০% মানুষ কোভিড-19 এর সময়ের থেকে ঘুম না হওয়ার সমস্যায় ভুগেছেন।ভয় পাবেন না,রাতে ঘুম না আসার কারন ও প্রতিকার সম্পর্কে আজকে আমরা কথা বলতে চলেছি।অনেকেরই এমন পরিস্থিতির শিকার হয় সারাদিন ঝিমানো ভাব থাকে ঘুমাতে ইচ্ছা করে কাজের সময়, কিন্তু রাতে ক্লান্ত হয়ে যখন বিছানায় যান কোনোভাবেই ঘুম আসে না।
এই অনিদ্রা সমস্যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ইনসমনিয়া বলা হয়।ইনসমনিয়া একটি স্লিপ ডিসঅর্ডার রোগ। আমাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই আমাদের শরীরে নানারকম রোগের বাসা সৃষ্টি করছে। একেক জন একেক সময়ে ঘুমাতে চান। অনেকেই ঘুমাতে চান যেকোনো সময়ে, যার কারণে যখন ঘুম আসার কথা সে সময়ে ঘুমের সমস্যায় পরতে হয়।
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপায়
রাতে অনিদ্রার এই সমস্যাকে সরিয়ে ঘুমকে নিজের সঙ্গি বানানো কিন্তু খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কিছু সহজ কৌশলেই আপনি নিজের ঘুম না হওয়ার সমস্যাকে দূর করতে পারবেন। চলুন, তাহলে জেনে নেই রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপায় কি কি ,
- যখন কোন মানুষ ঘুমান তাদের শারীরিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। আমরা যদি গরম পানি দিয়ে গোসল করি তখন লক্ষ্য করবেন আমাদের শরীরের তাপমাত্রা গোসলের পর কমে যায়। আপনার রাতের ঘুমের সমস্যার সমাধানের জন্য ঘুমের আগে কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিতে পারেন। এতে আপনার ক্লান্ত মনও শান্ত হবে আর ঘুম আপনার রাতের সঙ্গী হয়ে উঠবে।
- আমাদের শরীরে একধরনের এলার্ম সিস্টেম রয়েছে। যা আমাদের সঠিক সময়ে জানিয়ে দেয় কোন কাজটি দরকার এই সময়ে শরীরের। ঠিক সময়ে প্রতিদিন নিয়ম বেধে ঘুমানোর অভ্যাস করলে শরীর সঠিক সময়ে আপনার মস্তিস্ককে ঘুমানোর সিগন্যাল পাঠাবে।
- ঘুমানোর আগে ৩০-৪০ মিনিট একটু হাটাহাটি করতে পারেন খোলা আকাশের নিচে। এতে আপনার শরীরে ঘুমের হরমোন নিঃসৃত হওয়ার পরিমান বেরে যাবে।
- পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুতে ৬ মাস দিন এবং ৬ মাস রাত থাকে। যার কারণে, আমাদের শরীর রাত আর দিনের পার্থক্য করতে পারে না। আমাদের প্রাকৃতিকভাবে যে ক্লক সিস্টেম রয়েছে তা আমাদের ঘুমানোর জন্য মস্তিস্কে সিগন্যাল পাঠাতে থাকে। আমরা পর্যাপ্ত আলো বাতাসের মাঝে দিনের সময়টা নিজেদের কাজ করি তাহলে আমাদের শরীরে ঘুমের সিগন্যাল পাঠানো বন্ধ করে দিবে এবং রাতে সঠিক সময়ে ঘুম আসবে।
রাতে না ঘুমালে কি ক্ষতি হয়
রাতে ঘুমের অনিয়ম মানুষের শরীরে অনেক ধরনের রোগের বাসা বাধতে সাহায্য করে। আজকের প্রজন্মের তরুন তরুনীদের রাতে মোবাইল চালানোর অভ্যাসের কারণে রাতে ঘুমের পরিমান দিন দিন কমে যাচ্ছে। অনেকে সারারাত পড়ালেখা করেন সকালে ঘুমাতে যান। এই ধরনের অভ্যাসগুলো আমাদের এই প্রজন্মের শরীর ও মনে অনেক রকমের রোগের বাসা সাজাচ্ছে। এই প্রজন্মের তরুন-তরুনীদের ডিপ্রেশান, মুড সুইং বেশী হওয়ার কারণ পরিমান মতো ঘুম না হওয়া। ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
খাদ্যাভাস পরিবর্তন করুন
আমাদের জীবনের অনেক ধরনের অনিয়ম চলাফেরার কারনেই ঘুমের সমস্যার সৃষ্টি হয়।অনেকগুলো অনিয়মের মধ্যে আমাদের জীবনের খাদ্য অভ্যাসের প্রভাব রয়েছে। মানুষের শরীরের সকল কাজ খাদ্যের মাধ্যমেই পরিপূর্ণ হয়। পুষ্টিকর খাদ্য এর শরীরের সব কাজকর্মকে চলনসই রাখতে প্রয়োজন।
আপনার রাতে ঘুম না আসার কারণ আপনার প্রতিদিনের খাদ্য অভ্যাস হতে পারে। তাই, সঠিক খাদ্য অভ্যাস গ্রহন করুন।কিছু সাধারন খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন হয়ত আপনার রাতে ঘুম না আসার কারণ ধংস করে দিতে সক্ষম হবে।
কি খেলে ঘুম বেশী হয়
শরীরে প্রচুর ক্লান্তি ভাব থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ঘুমাতে পারেন না রাতে ঠিকমত। বর্তমানে গবেষকরা জানিয়েছেন এমন কিছু খাবার রয়েছে যা আমাদের অনিদ্রার সমস্যা থেকে বাচাতে পারবে। চলুন জেনে নেই কোন খাবারগুলো খাওয়া উচিত প্রতিদিনের ঘুমের পর্যাপ্ত চাহিদা মিটানোর জন্য।
দুধে রয়েছে অ্যামাইনো অ্যাসিড ট্রিপটোফএন যা আমাদের ঘুমের জন্য খুবই সহায়ক। এক গ্লাস গরম দুধ ঘুমানোর আগে খেয়ে নিলে রাতে ভালো ঘুম হয়। বাদামের মধ্যে কাঠবাদাম আমাদের স্নায়ু ও মাংসপেশিকে শান্ত করতে সহায়ক।
ভালো ঘুমের জন্য আমাদের স্নায়ু ও মাংসপেশিকে শান্ত করা প্রয়োজন। আমাদের মস্তিষ্কের যে নিউরন ঘুমানোর জন্য সহায়তা করে তার সাথে ভিটামিন ডি কাজ করে। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার ঘুম বেশী হওয়ার জন্য সবথেকে প্রয়োজনীয়। যেমনঃ ডিম, চিংড়ি মাছ, ভাত, ডাল, ডালিয়া, ওটস, কুইনোয়ার মতো দানাযুক্ত শস্য, চিজ বা পনির, মাশরুম, সামদ্রিক মাছ।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১ চিমটি কালজিরার সাথে মধু খেলে সারাদিন যেমন শরীর সুস্থ থাকে তেমন রাতে ঘুম গভির হয়। মধুতে উপস্তিত ভিটামিন সেরেটোনিন ও মেলাটোনিন তৈরি করে যা বেশী ঘুম আসতে সহায় করে। ঘুমানোর আগে ১ চামচ মধু খেলেও অনেক উপকারিতা রয়েছে।
লেটুস পাতা ঘুম বেশী হওয়ার জন্য সাস্থ্যকর খাবার। এটি গরম পানিতে সিদ্ধ করে পানি খেতে পারেন প্রতিদিন বিকালে ও সালাদ করেও খেতে পারেন। এসব খাবার ছাড়াও আখরোট, সবজির স্যুপ, অ্যাপেল, কিশমিশ, কলা, মিস্টি আলু সহ আরও অনেক সাস্থ্যকর খাবার রয়েছে যা আমাদের শরীর এর সকল হরমোনকে ঠিক মতো পরিচালনা করে থাকে। বাহিরের ভাজাপোড়া খাবার থেকে নিজেকে দূরে রাখুন।হাই প্রেসার বা উচ্চ রক্ত চাপ এর লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন।
রাতে দেরিতে ঘুমালে কি হয়
সঠিক সময়ে না ঘুমানোর ফলে , আমাদের মস্তিস্ক সঠিকভাবে কাজ করে না। অনেক সময় এর কারণে আমরা আমাদের কাজে আশানুরপ ফলাফল অর্জন করতে ব্যার্থ হই। মোবাইল, ল্যাপটপ এর যেমন বেটারি চার্জ করতে হয় ঠিক তেমন আমাদের শরীরের চার্জার এর প্রয়োজন হয়। সঠিক সময়ের পর্যাপ্ত ঘুম আমদের শরীরের চার্জার। যা শরীর ঠিক মতো না পেলে কাজ করতে পারে না দুর্বল হয়ে পরে মস্তিস্ক।
কয়েকটি গবেষনায় দেখা গিয়েছে যে, অনিয়ম ঘুমের সাথে মানুষের শরীরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং মোটা হওয়ার সম্পর্ক অনেক গভীর।
একটি মানুষ একনাগারে ৩ মাস ঘুমের অনিয়ম করলে তার মৃত্যু হতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুমের কমতির কারণে তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেরে যায়।
রাতে সঠিক সময়ে ঘুমাতে না পারলে ধীরে ধীরে মানুষের পেনিক অ্যাটাক, ফবিয়ার মতো মানুষিক সমস্যা পরিলক্ষিত হয়।
এছাড়াও আরও অনেক ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে যেমন,
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
- সর্দি লাগার প্রবনতা বেড়ে যায়
- হৃদযন্ত্রের রোগ ঝুঁকি দেখা দেয়
- রক্তের হিমোগ্লোবিন কমতে থাকে এবং রক্তের প্রবাহ ক্ষমতা কমতে থাকে
- মাথা ঝিমঝিম করা
- কাজে মনোযোগ দিতে না পারা
- সারাদিন ঝিমানো ঝিমানো ভাব
- স্মরণশক্তি হ্রাস পায়
- কাজকর্মের গতি হারানো
- ত্বকে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হয়
বয়স অনুযায়ী ঘুমের তালিকা
মানুষের একেক বয়সে ঘুমের পরিমান একেক রকম। বয়স অনুযায়ী পর্যাপ্ত ঘুমের সুসাস্থ্য বজায় রাখতে প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ঘুম এর যেমন প্রয়োজনীয়তা অনেক ত্মন অতিরিক্ত ঘুমও ক্ষতিকর। আমাদের সবার উচিত বয়স অনুজায়ী ঘুমের পরিমান সম্পর্কে জানা এবং অনন্যদেরকে সতর্ক করা। আসুন জেনে নি বয়স অনুযায়ী ঘুমের তালিকা,
শূন্য থেকে ৩ মাস বয়সী |
১৪ থেকে ১৭ ঘণ্টা |
৪ মাস থেকে ১১ মাস |
১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা |
১ থেকে ২ বছর বয়সী |
১১ থেকে ১৪ ঘণ্টা |
৩ থেকে ৫ বছর বয়সী |
১০ থেকে ১৩ ঘণ্টা |
৬ থেকে ১৩ বছর বয়সী |
৭ থেকে ৮ ঘণ্টা |
১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সী |
৮ থেকে ১০ ঘণ্টা |
১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী |
৭ থেকে ৯ ঘণ্টা |
২৬ থেকে ৬৪ বছর বয়সী |
৭ থেকে ৯ ঘণ্টা |
৬৫ বছরের বয়সী |
৬ থেকে ৭ ঘন্টা |
পরিশেষে এটাই বলব যে, নিজের শারীরিক সুস্থতা নিজের কাছেই। শরীর সুস্থ না থাকলে জীবনে কোনকিছুতেই নিজের সফলতা কাম্য করা শুধুমাত্র স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। নিজেকে সুস্থ রাখতে ঘুম প্রয়োজন। ঘুমের বেশী সমস্যা হলে কাউন্সিলরের সাহায্য নিতে পারেন।রাতে ঘুম না আসার কারন ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।
তথ্যসূত্রঃ
https://stanfordhealthcare.org/medical-conditions/sleep/delayed-sleep-phase-syndrome.html
https://www.healthline.com/health/sleep-deprivation/delayed-sleep-phase-syndrome