ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু জ্বরের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর মাসগুলোতে এদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে।বর্তমানে আমাদের দেশে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। অসংখ্য প্রাণ ঝরে যাচ্ছে।তাই আজকে আমরা ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
ডেঙ্গু/এডিস মশার উৎপত্তি
এডিস মশা হলো ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম বাহক। আমাদের আশেপাশেই রয়েছে অসংখ্য এডিস মশা। এডিস মশা যে সকল স্থানে জন্মায় বা বাস করে-
- ড্রেনের জমা পানি
- গাড়ির টায়ারে জমা পানি
- ফুলের টব
- ছাদের জমা পানি
- গাছের কোটরে জমা পানি
- ভাঙা বালতি,মগ,কাপ,হাড়িপাতিলে জমা পানি।
- ঝোপঝাড়
- নির্মানাধীন ভবন
- পরিত্যক্ত ভবন
কিভাবে বুঝবো ডেঙ্গু হয়েছে?
শরীরের প্রতি ১ মিলি লিটার রক্তে ৩০-৪০ হাজার প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা থাকে। এই প্লাটিলেট প্রতিদিন ধ্বংস হয় এবং গঠিত হয়। কিন্তু ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগীর প্লাটিলেট কণিকা ধ্বংস হয় এবং সংখ্যায় অনেক কমে যায়, ফলে রোগী মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
সাধারণত কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যায় ডেঙ্গু হয়েছে কি না। তবে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ:
সাধারণ জ্বর আর ডেঙ্গু জ্বরের কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ডেঙ্গু একটি মারাত্মক জ্বর।
কিছু লক্ষণ দেখে ডেঙ্গুর ধারণা পাওয়া যায়। যেমন-
- তীব্র জ্বর
- মাথাব্যথা
- গাত্রে ব্যাথা
- শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ
- বমি বমি ভাব ও বমি
- পেশিতে তীব্র ব্যাথা
- কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেটে ব্যাথা
ডেঙ্গু জ্বর হলে কি কি খেতে হয় বা ডেঙ্গু হলে কি কি খাওয়া যাবে?
যেকোনো অসুস্থতা বা জ্বর হলে শরীরের জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। তাছাড়া জ্বরে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় ফলে রোগী কিছু খেতে চায় না। কিছু না খেলে রোগীর শরীর দূর্বল হয়ে যায়। এতে রোগীর অবস্থা আরও বেশি খারাপ হতে থাকে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে যা যা খাওয়া উচিত-
- ডাবের পানি
- জাউ ভাত (নরম/তরল ভাত)
- পানি জাতীয় তরল খাবার
- স্যুপ
- কমলা
- স্যালাইন
- পেপে পাতার জুস
- হলুদ
- মেথি
- ব্রুকলি
- পালংশাক
- কিউইফল
নইম,তুলশী, গুলঞ্চ, অ্যালোভেরা,বার্লি ইত্যাদি ব্যবহারে রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
ডেঙ্গু হলে কি কি খাওয়া যাবে না?
ডেঙ্গু খুবই স্পর্শকাতর একটি রোগ। তাই ডেঙ্গু হলে খাবারের ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকতে হবে। সব ধরনের খাবার রোগীকে খাওয়ানো যাবে না।
ডেঙ্গু হলে যেসব খাবার খাওয়া যাবে না –
- তেলযুক্ত খাবার
- তেলে ভাজা খাবার
- মসলাযুক্ত খাবার
- ক্যাফেইনযুক্ত খাবার (চা, কফি)
- সিঙ্গারা,পুরি,পেয়াজু ইত্যাদি এড়িয়ে চলাই উত্তম।
ডেঙ্গু জ্বর কতদিন থাকে?
ডেঙ্গু হলে ভালো হতে/সাড়তে কতদিন লাগবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১-২ সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বর ভালো হয়ে যায়।
ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা/ ডেঙ্গু হলে করণীয় কি?
ডেঙ্গু সাধারণ জ্বরের মতো একটি জ্বর হলে এটি সাধারণ জ্বর থেকে একটু বেশি মারাত্মক ও উদ্যেগজনক।ডেঙ্গু জ্বর হলে কি গোসল করা যাবে কিনা জানতে চাইলে ক্লিক করুন লিঙ্কে।
অনেকেই জানেন না ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা কিভাবে নিতে হয় বা ডেঙ্গু হলে করণীয় কি?
ডেঙ্গু জ্বর ৩ ধরনের।
১. এ
২. বি
৩. সি
প্রথম টাইপের রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। এদের তেমন সমস্যা সৃষ্টি হয় না।
এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা বাড়তেই নেওয়া যায়। শুধু ঠিকমতো ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জ্বরের ঔষধ ও নিয়ম মেনে খাওয়া দাওয়া করলেই রোগ সেরে যায়।
টাইপ বি এর ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা যায়। এদের ক্ষেত্রে মাথা ব্যাথা, পেট ব্যাথা, তীব্র শরীর ব্যাথা দেখা যায়। এদেরকে অতি দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত।
টাইপ সি এর ক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে।
এ ধরনের রোগীকে অতি দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এদের জন্য ICU বা নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রয়োজন হয়।
ডেঙ্গু জ্বরে অনেকের রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা কমে যায়। রক্তের প্লাটিলেট পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা আছে তাদের ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে অতি দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
গর্ভবতী ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেও উপসর্গ দেখা গেলে বা ডেঙ্গু হলে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।
ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে রক্তপাত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অনেক রোগী রক্তপাত, প্লাটিলেট কমে যাওয়া,ফুসফুসের সমস্যা ও অন্যান্য শারীরিক জটিলতায় মৃত্যুবরণ করে।হাই প্রেসার বা উচ্চ রক্ত চাপ এর লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে লিঙ্কে ক্লিক করুন।
ডেঙ্গু রোগের ঔষধ কি?
ডেঙ্গু রোগের ঔষধ/ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় সাধারণ জ্বরের চিকিৎসা পদ্ধতিই ব্যবহৃত হয়।
তবে ডেঙ্গু হলে কিছু কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয়।
যেমন – এন্টিবায়োটিক বা ব্যাথা নাশক কোনো ঔষধ সেবন করা যাবে না। এতে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জ্বর ১০৫° ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে।
প্যারাসিটামল বা নাপা খাওয়া যাবে। একজন রোগী ২৪ ঘন্টায় ৬ টি প্যারাসিটামল খেতে পারবে।
জ্বরের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করলে সাপোজিটর ব্যবহার করতে হবে।
তবে যে কোনো অবস্থাতেই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করতে হবে।
ডেঙ্গুর রোগের জন্য কোন হাসপাতাল ভালো?
যেকোনো হাসপাতালেই ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা করা হয়।ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়,স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ার কারণে ঢাকা মহাখালীর বিশেষায়িত করোনা হাসপাতাল ও ডিএনসিসির করোনা হাসপাতালকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও যেকোনো জেলা ও উপজেলা সদর হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা করা হয়।
যদি রোগীর অবস্থা খারাপ হয় তাহলে রোগীকে ICU আছে এমন হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সেবাযত্ন
রোগের চিকিৎসা বা ঔষধের মতো সেবাযত্নও সমান কার্যকরী। ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগীর সেবাযত্ন অধিক প্রয়োজন ।
ডেঙ্গু উপসর্গ পাওয়ার পর এবং নিশ্চিত হওয়ার পর রোগীকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
থার্মোমিটার দিয়ে ২ ঘন্টা পর পর জ্বর মাপতে হবে।
অধিক জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে। যদি জ্বরের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করে তবে সাপোজিটার ব্যবহার করতে হবে।
জ্বর জলে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, রোগী খেতে চায় না।এতে শরীর দূর্বল হয়ে গেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কষ্ট হলেও রোগীকে বুঝিয়ে পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।আপনি যদি ডায়বেটিস সম্পর্কে জানতে চান তবে লিঙ্কে ক্লিক করুন ডায়াবেটিস কমানোর উপায়
ডেঙ্গু জ্বর থেকে বাঁচতে করণীয়
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ সহ এশিয়ার দেশগুলোতে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব উদ্যেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। এডিস মশার বিস্তার রোধ করতে হবে।
সিটি করপোরেশন ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মশা নিধনে কাজ করছে।
আমাদেরও কিছু নিয়ম ও অভ্যাস মেনে চলতে হবে –
- মশারী ব্যবহার করতে হবে।
- পড়ার সময় বাচ্চাদের কয়েল ব্যবহার করতে হবে।
- হাতে পায়ে এন্টি মস্কিউটো ক্রীম ব্যবহার করতে হবে।
- বাড়ির চারপাশে পরিস্কার রাখতে হবে।
- বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্রে কোথাও যেনো পানি৷৷ জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
- ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষন দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বর অন্যতম ভয়াবহ একটি জ্বর।এমনকি এটি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।তাই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করাই উত্তম।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/dengue-fever/symptoms-causes/syc-20353078